উখিয়ায় বেপরোয়া বালুদস্যুদের হাতে প্রাণ হারান উখিয়া দোছড়ির রেঞ্জ এর বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাজ্জাদুজ্জামান । রবিবার গভীর রাতে পাহাড়ের মাটি ও বালু রক্ষার অভিযানকালে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। রাত ৩টায় বালু ও মাটি পাচারের খবরে রাস্তায় অভিযানে নামা বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাজ্জাদুজ্জামান হরিণমারা এলাকায় একটি ডাম্পার গাড়ির ড্রাইভারকে থামার নির্দেশ দেন। কিন্তু বেপরোয়া ড্রাইভার গাড়ি না থামিয়ে সাজ্জাদুজ্জামানকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের উখিয়া ও ইনানী রেঞ্জে রাতের আঁধারে বনবিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়ত পাচার করা হচ্ছে শত শত ডাম্পার পাহাড়ের মাটি ও বালি। বন সম্পদ রক্ষাকবচ হিসেবে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত পাহাড় সাবাড় করছে পাহাড়খেকো সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
উখিয়া রেঞ্জে নিয়মিত অভিযানে ডাম্পার জব্দ করা হলেও সুকৌশলে বন কর্মকর্তাদের পাহারা দিয়ে পাচার কাজ অব্যাহত রাখে মাটিখেকো চক্র। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাটি পাচার করা হয় উখিয়া রেঞ্জ ও ইনানী রেঞ্জের সীমানাবর্তী হরিণমারা ও তুতুরবিল এলাকা থেকে।
অন্যদিকে, পাহাড় সাবাড় করে ভরাট করা হচ্ছে নিচু কৃষিজমি। এ নিয়ে উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তার নির্দেশে কোর্টবাজার এলাকার একটি কৃষিজমি ভরাটের দৃশ্য ধরা পড়লে নোটিশ প্রদান করে জবাব চাওয়া হয়।
বিট কর্মর্তাকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়া ডাম্পারটি পার্বত্য উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম এলাকা থেকে স্থানীয় জনতা আটক করে প্রশাসনের নিকট হস্তান্তর করেছে।
রবিবার দুপুরের দিকে ঘাতক ডাম্পারটি উখিয়া নিয়ে আসেন উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি) সালেহ আহমদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম। থানা পুলিশের ওসি(তদন্ত) নাছির উদ্দীন মজুমদারের উপস্থিতিতে তদন্তের স্বার্থে জব্দকৃত ডাম্পার থানা হেফাজতে রাখার নির্দেশ প্রদান করেন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সালেহ আহমদ।
অন্যদিকে, ডাম্পার চাপায় নিহত বিট কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামানের মরদেহবাহী এ্যাম্বুলেন্স মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় জানাযা শেষে দাফন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম। তার মৃত্যুতে সর্বত্র নেমে এসেছে শোকের ছায়া। পাহাড়খেকোদের ডাম্পারে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করা বিট কর্মকর্তা সদা মিষ্টভাষী ছিলেন বলে জানান শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
কর্মকর্তা নিহতের পরপরই দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা সরোয়ার আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
তিনি বলেন, আমরা একজন দক্ষ বন কর্মকর্তাকে হারালাম। পাহাড়খেকোদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তথা সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে।
এদিকে মার্চ মাসে কয়েকটি পৃথক অভিযান পরিচালনা করে রাজাপালং ইউনিয়নের দরগাহবিল হাতিমোরা ও থাইংখালী গৌজঘোনা এলাকা হতে ডাম্পার জব্দ করে বনবিভাগ। এরপর থেকে দিন দিন কৌশল পরিবর্তন করে পাহাড় সাবাড় কার্যক্রম অব্যাহত রাখে পাহাড়খেকোরা। হরিণমারা এলাকায় ডাম্পার চাপা দেওয়া চালক বাপ্পিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ডাম্পারের মালিক একই এলাকার ছৈয়দ করিম বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এদিকে, এলাকায় খোঁজ নিয়ে দায়িত্বশীল জানা গেছে , হিজলিয়া সড়ক দিয়ে ঢুকে ৪০ টি অবৈধ ডাম্পার দিনে রাতে পাহাড়ের মাটি ও বালি পাচার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যে যেখানে পারছে বালি মজুত করছে। হিজলিয়া থেকে শুরু করে হরিনমারা হয়ে খয়রাতি পাড়া পর্যন্ত সড়কের দু পাশে মজুত করা রয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ বালি। এমন কোন জায়গা নেই যেখানে বালির মজুত নেই।
পাহাড়কাটা ও বালি পাচার কাজে নিয়োজিত অবৈধ ডাম্পার মালিকদের মধ্যে রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণ মারা ও বাগানের পাহাড় এলাকার মোহাম্মদ কোম্পানি, গফুর কোম্পানি, মাহমুদুল হক, ছৈয়দ করিম, মাস্টার কবির আহমেদ, বদু প্রকাশ ফিটিং বদু, শাহ আলম, কানা সৈয়দ করিম, হিজলীয়া একেএনসি স্কুল সড়ক ঠান্ডা মিয়ার ছেলে বাবুল, জাদিমোরা এলাকার সাইফুল কবির, আলিমোরার জামাল, হিজলিয়া মাজর পাড়া এলাকার মৌলভী রেজা।
তাদের সহযোগি হিসেবে রয়েছে হিজলিয়ার আব্দুল্লাহ, হেলাল, রশিদ, উত্তর পুকুরিয়ার বেলাল, তুতুরবিলের সালাহ উদ্দিন, কুতুপালং এলাকার মংচানু বড়ুয়া, কুতুপালং পিএফপাড়া এলাকার সাগর বড়ুয়া প্রমুখ।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম বলেন, আমরা অবৈধ ডাম্পারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছি। গত কয়েকদিন আগেও মাটি ভর্তি একটি ডাম্পার আটক করে মামলা দিয়েছে। বিট কর্মকর্তা সহ আমরা বনকর্মীরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সরকারের বনসম্পদ রক্ষার্থে।
দোছড়ি বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদ সরকারি সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের প্রাণটা পর্যন্ত দিয়ে দিলো। অবৈধ ডাম্পার, বালি উত্তোলন,পাহাড় কাটা, অবৈধ সমিল সহ সবকিছুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এই অভিযান শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। বিষয় গুলো নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জের সাথে আলোচনা করা হয়েছে।
কয়েকজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না শর্তে জানান, উখিয়া পাহাড় খেকো সিন্ডিকেট গুলো বেপরোয়া ও ভংয়কর। তারা মূর্তিমান আংতকের নাম হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে । এরা দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি চরম অশ্রদ্ধাশীল। এই সিন্ডিকেটকে কোন ভাবেই থামানো যাচ্ছে না। এই চক্রের কারনে উখিয়া পুরোপুরি ধ্বংসের পথে। পাহাড় ধ্বংসকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উখিয়া রেঞ্জে দায়িত্বরত বন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও ইনানী রেঞ্জের দায়িত্বরত বন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে রহস্যজনক কারনে। এ নিয়ে উখিয়ায় চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
পাঠকের মতামত